সড়ক দুর্ঘটনা কিংবা মানুষের নির্যাতনে আহত কুকুর-বিড়াল উদ্ধার করে সুরক্ষা ফান্ড বা চিকিৎসার নামে বিপুল টাকা আত্মসাৎ করছে একটি বেসরকারি সংগঠন। তারা দানের টাকায় কুকুর-বিড়ালের নামে খাবার কিনে তা ব্যবহার করছে নিজেদের রেস্তোরাঁয়- এমন অভিযোগও উঠেছে। আর এই মুরগি কেনার খরচ তোলার জন্য বিভিন্ন মাধ্যমে মানি রিসিট পোস্ট করে সহায়তা আহ্বান করে ‘কেয়ার ফর পজ’ নামের সংগঠনটি।
ওই সংগঠনের কাছে নিজের পোষা প্রাণী রেখে প্রতারণার শিকার কয়েকজনের ভাষ্যমতে, কেউ নিজের পোষা অসুস্থ কুকুর-বিড়াল ওই সংগঠনের কাছে চিকিৎসা ও খাবার খরচসহ রেখে এলেও এর ছবি দিয়ে ফান্ড জোগাড় করে তারা। এমনকি মেরে ফেলে ওই প্রাণীটির ছবি দিয়ে চাঁদা আহ্বান করে সংগঠনটি। চাঁদা সংগ্রহের জন্য তাদের রয়েছে বিকাশ, রকেট, পে-পল, ওয়েস্টার্ন, মানিএক্সপ্রেস, ওয়ান ব্যাংক, সিটি ব্যাংকসহ নানা প্রতিষ্ঠানে অ্যাকাউন্ট।
তারা রাজধানীর অদূরে কেরানীগঞ্জের মালঞ্চ এলাকায় গড়ে তুলেছে পশুদের একটি আশ্রম। সেটি পরিচালনা করছেন সৌরভ শামীম ও জাহিদ হোসেন নামে দুই তরুণ।
কুকুর-বিড়ালের ফান্ডের টাকায় রাজধানীতে গড়ে তুলেছেন একটি রেস্টুরেন্ট। প্রাণীদের অনুদানের মাংস প্রাণীরা না পেলেও সেই মাংসে চলে সংগঠনের কর্তাদের গড়ে তোলা রেস্টুরেন্ট।
ধানমন্ডির জিগাতলায় একটি পশু হাসপাতাল করেছেন তারা। রাস্তা থেকে আহত কুকুর-বিড়াল উদ্ধার করে প্রথমে নেয়া হয় তাদের হাসপাতালে। সেখান থেকে নিয়ে যাওয়া হয় কেরানীগঞ্জের আশ্রমে। এরপর প্রতিষ্ঠানের ফেসবুক পেজ ‘কেয়ার ফর পজ’-এ আহত কুকুর-বেড়ালের ছবি দিয়ে পোস্ট দেয়া হয়। সেখানে প্রাণীগুলোর চিকিৎসায় ফান্ড চেয়ে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও বিকাশ নম্বর দেয়া হয়। পশুপ্রেমী অথবা প্রবাসী অনেকে খাবার ও চিকিৎসায় সাহায্য পাঠান।
ওই সংগঠনের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে কখনো সংযুক্ত হয়েছেন এমন অনেকে বলেন, বিভিন্নভাবে সাহায্য এলেও অনাহারে কিংবা বিনা চিকিৎসায় থাকতে হয় এই বোবা প্রাণীগুলোর।
জানা যায়, মোহাম্মদপুর বসিলা এলাকায় ২০১৫ সালে সংগঠনটি তাদের কাজ শুরু করে। রাস্তার আহত কুকুর-বিড়াল উদ্ধার করে তাদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেয়া এবং সুস্থ হলে সেটি আবার এলাকায় ছেড়ে দিয়ে আসত সংগঠনটি। তাদের ব্যতিক্রমী এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানায় সবাই।
কুকুর-বিড়ালের সংখ্যা বাড়লে পশুপ্রেমী একজন প্রবাসী নারী এই সংগঠনকে কেরানীগঞ্জের মালঞ্চ এলাকায় বড় একটি জায়গা দেন। সেখানে শতাধিক কুকুর-বিড়াল লালনপালন করা হয়। আহত প্রাণীগুলো সুস্থ হয়ে উঠলে সেগুলো রাস্তায় ছেড়ে দেয়া হয়। আর ব্যক্তিগত কোনো প্রাণী হলে চিকিৎসা শেষে মালিকের কাছে ফিরিয়ে দেয়া হয়। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মালিককে চিকিৎসার টাকা দিতে হয়।
এদিকে ভাড়ার টাকা পরিশোধ না করারও অভিযোগ উঠেছে সংগঠনটির বিরুদ্ধে। কেরানীগঞ্জে কার্যক্রম শুরু করার পর এক বছর জমির ভাড়া দিতে হয়নি প্রতিষ্ঠানটিকে। কিন্তু গত বছরের মাঝামাঝি ৩৫ হাজার টাকা চুক্তি হলেও দীর্ঘদিন ধরে ভাড়া পান না জমির মালিক।
জমির মালিক নীলা হাবিবা ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘আমি পশুদের প্রতি খুবই দুর্বল। প্রথমে সংগঠনটির কার্যক্রম আমার খুব ভালো লাগত। তাই জমিটা প্রথম এক বছর ফ্রি দিয়েছিলাম তাদের। গত বছর থেকে ভাড়ার চুক্তি করা হয়। কিন্তু কয়েক মাস ধরে ভাড়া পাচ্ছি না।’
এই নারী এখনো প্রায়ই তার জমিতে গড়ে ওঠা পশু আশ্রমে প্রাণীগুলোর জন্য খাবার কিনে নিয়ে যান। কিন্তু সেখানে প্রাণীগুলোর প্রতি অবিচার করা হচ্ছে বলে মনে করেন তিনি। বলেন, ‘এত বড় জায়গা পেয়েও সংগঠনটি কুকুর-বিড়ালের প্রতি অবিচার করছে। এতগুলো প্রাণীর জন্য ছোট্ট একটি রুম করে রেখেছে। হালকা বৃষ্টি হলে সেখানে পানিও পড়ে।’
তাকে ভাড়া দিচ্ছে নাম কিন্তু প্রাণীগুলোর প্রতি যদি যথাযথ যতœ নেয়া হতো তাহলেও কিছুটা সান্ত¡না পেতেন নীলা হাবিবা। বলেন, ‘আমাকে ঠিকমতো ভাড়া না দিলেও নিরীহ প্রাণীগুলোকে তো ঠিকমতো দেখভাল করবে, কিন্তু তা করে না। অনেক সময় দেখেছি সকাল থেকে খাবার দেয়া হয় না। আবার বিড়ালের জন্য মেয়াদোর্ত্তীণ খাবার কিনে খাওয়ানো হয়। কুকুর-বিড়াল ও ঘোড়া মিলে প্রায় ৭০টির বেশি প্রাণী তাদের এখানে মারা গেছে।’
বর্তমানে সংগঠনটির ফান্ড জোগাড় করা মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে- উল্লেখ করে তিনি বলেন, কুকুর-বিড়ালের নামে নিজেদের ভাগ্য গড়ছে সংগঠনের পরিচালকরা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সংগঠনের দুই সদস্য রাজধানীর ৬০ ফিট রোডে গড়ে তুলেছেন থার্স ডে নাইট নামে একটি রেস্টুরেন্ট। এর জন্য মুরগি কিনে তা ফেসবুকে প্রচার করা হয় আহত প্রাণীদের খাবার বলে। ঢাকা টাইমসের কাছে এ রকম তথ্য-প্রমাণ আছে।
সংগঠনটির নামে বিভিন্ন মুরগির দোকানের রশিদ ফেসবুকে পোস্ট করে বলা হয়- ‘মুরগির দোকানে টাকা বাকি আছে। টাকা পরিশোধের আহ্বান জানিয়ে সাহায্যে চাওয়া হচ্ছে।’ এতে অনেকে বিকাশের মাধ্যমে মুরগির দোকানিকে সরাসরি টাকা পাঠিয়ে দেন। প্রাণীদের জন্য কেনা এসব মুরগি প্রথমে পাঠানো হয় সৌরভ ও জাহিদের রেস্টুরেন্টে। সেখান থেকে হাড়, গলা, পা পাঠিয়ে দেয়া হয় পশুদের আশ্রমে।
সংগঠটির চেয়ারম্যান সৌরভ শামীমের দাবি, ‘মুরগির দোকান থেকে আশ্রম এবং রেস্টুরেন্টের মাংস তারা একসঙ্গে কেনেন। রেস্টুরেন্টে নিয়ে পরে সেগুলো আশ্রমে পাঠানো হয়। এখানে প্রাণীদের জন্য পরিশোধ করা মাংস রেস্টুরেন্টে ব্যবহার করা হয় না।’
আগে পশু আশ্রমের জন্য কেরানীগঞ্জ থেকে মুরগি কেনা হতো। কিন্তু রেস্টুরেন্ট দেয়ার পর মুরগি কেনা হচ্ছে এর কাছের একটি দোকান থেকে। এ বিষয়ে জানতে জাইলে সৌরভের দাবি- ‘আগে কেরানীগঞ্জ থেকে মাংস কেনা হলেও দোকানি তাদের সঙ্গে প্রতারণা করত। তাই ৬০ ফিট রোডে তার রেস্টুরেন্টের পাশের একটি দোকান থেকে মুরগি নেয়া হচ্ছে।’
সংগঠনের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ
পশুদের প্রতি ভালোবেসে এরই মধ্যে গড়ে উঠছে নানা সংগঠন। প্রশংসিত এই কাজটি এখন জড়াচ্ছে বিতর্কের বেড়াজালে। নিরীহ প্রাণীদের নিয়ে চলছে দেশি-বিদেশি অনুদান বাণিজ্য। ফলে এখন বোঝা দায় কোনটা প্রাণীপ্রেম আর কোনটা ব্যবসার ফাঁদ।
রুকসাত হক নামের এক নারী ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘সংগঠনটির আশ্রমে চিকিৎসার জন্য আমার একটি পোষা কুকুর পাঠানো হয়। টাকা ও প্রয়োজনীয় ওষুধ দিয়েছি। চিকিৎসার কথা বলে তারা টাকা নিতে থাকে। এরপর প্রায় দুই সপ্তাহ সংগঠনের দুই মালিককে ফোন করে পাইনি। সরাসরি সেখানে গিয়ে দেখি কুকুরের অবস্থা খুবই খারাপ। তারা চিকিৎসার নামে টাকা নিলেও কোনো চিকিৎসা করেনি। উল্টো আমার কুকুরের ছবি তুলে ফেসবুকে তাদের গ্রুপে সাহায্য চেয়ে পোস্ট করেছে।’
সেখান থেকে তার কুকুরটি নিয়ে যান ওই নারী। অন্যত্র চিকিৎসায় পুরোপুরি সুস্থ হয়ে গেছে পোষা কুকুরটি। তিনি বলেন, ‘পরে জানতে পেরেছি চিকিৎসার ওষুধ দিয়ে এলেও তারা সেগুলো ব্যবহার করে না। তাদের হাসপাতালের অন্য প্রাণী এলে তাদের মালিকদের কাছে বিক্রি করে দেন।’
এই আশ্রমে গত ছয় মাসে অর্ধশতাধিক কুকুর মারা গেছে বলে জানতে পেরেছেন ওই নারী। বলেন, ‘তারা ইনজেকশন দিয়ে অনেক কুকুর মেরে ফেলে। সংগঠনটি রাস্তার প্রাণীদের নিয়ে কাজ করে নাম-ডাক কামিয়েছে। সেটাকে পুঁজি করে তারা মানুষকে ঠকাচ্ছে।’
মনোয়ারা আক্তার মুনিয়া নামের আরেক নারী জানান, গাড়ির চাকার সঙ্গে ঘষা লেগে তার কুকুরটির গায়ের চামড়া উঠে গিয়েছিল। এতে কুকুরের শরীরে ক্ষত হতে পারে ভেবে কেয়ার ফর পজের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে সেখান থেকে আশ্রমে পাঠানো হয়। এ সময় তাদের টাকা দিয়ে আসেন তিনি।
কিন্তু কেয়ার ফর পজ ওই কুকুরকে কোনো খাবার খাওয়ায়নি, চিকিৎসাও করায়নি। বলেন মুনিয়া, ‘পরে কুকুরটি মারা গেছে। আমাকে কিছু না জানিয়ে তারা মাটিচাপা দেয়। কিন্তু তাদের ফেসবুক পেজে কুকুরটি আহত জানিয়ে দিনের পর দিন ডোনেশন চাইতে থাকে।’
কেয়ার ফর পজের বক্তব্য
সংগঠনটির চেয়ারম্যান সৌরভ শামীম তার সংগঠনের বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে দাবি করেন। বলেন, ছোটবেলা থেকে রাস্তার প্রাণীদের প্রতি তার টান ছিল। নিজের বাড়িতে প্রথমে গড়ে তুলেছিলেন আশ্রম। পরে বড় পরিসরে কাজ শুরু করেন।
অর্থ আত্মসাৎ ও ইনজেকশন দিয়ে প্রাণী হত্যার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি আমার নিজের বাড়ি বিক্রি করে এসব প্রাণীর জন্য টাকা খরচ করি। আর সেখানে তাদের ডোনেশনের টাকা আত্মসাতের কোনো প্রশ্নই আসে না। আর ইনজেকশন দিয়ে কখনো প্রাণীদের হত্যা করা হয় না। হায়াতের মালিক যিনি তিনিই নিয়ে যান।’
এসব নিয়ে বিস্তারিত কথা বলতে এই প্রতিবেদককে কেরানীগঞ্জের আশ্রমে যেতে বলেন সৌরভ।
আশ্রমের খরচ জোগানের বিষয়ে সৌরভ বলেন, ‘এখানে জায়গার ভাড়া, খাবার খরচসহ প্রায় এক লাখ ৭০ হাজার টাকা খরচ হয়। এর বেশির ভাগ টাকা পাবলিক ডোনেশন এবং ধানমন্ডির পশু ক্লিনিক থেকে আসে।’